নিজস্ব প্রতিবেদক:
একরামুলসহ সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে, গনতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় খুনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মানববন্ধন করেছে গনসংহতি আন্দোলন নারায়নগঞ্জ জেলা।
সোমবার(৪ জুন) সকাল ১১টায় প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
গনসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়ক অঞ্জন দাসের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন গনসংহতি আন্দোলনের নারায়নগঞ্জ জেলার প্রধান সমন্বয়ক তরিকুল সুজন।
সভাপতির বক্তব্যে তরিকুল সুজন বলেন, আমরা মনে করি বাংলাদেশে আরো আগে এরকম প্রতিবাদ হওয়ার দরকার ছিল। ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে সরকার ক্রসফায়ার বন্ধুকযুদ্ধ নামে মানুষ খুন করছে। গত ২০ দিনে সরকার বিনাবিচারে কোন ধরনের বিচারের মুখোমুখি না করে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে মানবিক অধিকার থেকে সমস্ত অধিকার থেকে দূরে ঠেলে ১৩০ জন মানুষকে হত্যা করলো। যারা মাদক সেবন করছে এবং যারা মাদক বিক্রি করছে তারা অপরাধী তারা দেশের অপরাধী তারা জাতির অপরাধী। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপরাধী। আমরা সেই অপরাধীর বিচার চাই কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদেরকে খুন করে ফেলা হবে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করাটা ছিল এই রাষ্টের গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার রাষ্ট্রের কথা আমরা বলছি। সেখানে বিনা বিচারে হত্যার জন্য আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করিনি। যারা গনতন্ত্রের কথা বলেন, প্রগতিশীলতার কথা বলেন, দেশের উন্নয়নের কথা বলেন, এমন কোন মানুষ পাবেন না যারা বলবে বিনা বিচারে খুন করো। রাষ্ট্রের জনগন খুন করার দায়িত্ব আপনাদের দেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি যে অন্যায় মাদক সেবিরা আর মাদক বিক্রেতারা করছেন তার জন্য রাষ্ট্র আছে তার জন্য বিচার আছে তার জন্য প্রশাসন আছে। তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তাদেরকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিন।
তিনি আরও বলেন, যারা এই মানববন্ধনে দাড়িয়ে আছেন, যাদের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে, আর যারা ১৩০ জন খুনের শিকার হয়েছে তাদের হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে, ভেতর পুড়ে যাচ্ছে, এই একই প্রক্রিয়ায় পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শাসনকাঠামো। পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের গনতন্ত্র, পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যদি বিচার ছাড়া ক্রসফায়ারে করবেন তাহলে প্রশাসন রেখেছেন কেন। কেন বিচার কিংবা আদালত রেখেছেন। কোন দরকার ছিল না। ১৯৭১ সালের আমেরিকা তখন ২৭ জুলাই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল সেই থেকে ৪৫ বছর আজকেও আমেরিকাতে এখনো ১০% এর উপরে মাদক সেবি আছে। ২০১৩ সালে ৪ বছরে কম্বোডিয়ায় দশলক্ষ মানুষকে খুন করা হয়েছে। এই মাদকবিরোধী সন্ত্রাসের নামে, যুদ্ধের নামে। আমরা বিচার চাই, আমরা ক্রসফায়ার চাই না। আমরা মনে করি যারা খুনি তাদেরকে বিচার করতে বাংলাদেশে আইনে শাসন আছে, গনতন্ত্র আছে, সংসদ আছে, সংবিধান আছে।
তরিকুল আরও বলেন, ক্রসফায়ার করে বাংলাদেশে টিকে থাকতে পারবেন না। যদি টিকে থাকতো তাহলে খালেদা জিয়াই টিকে থাকতো, এরশাদ টিকে থাকতো, ইয়াহিয়া ও টিকে থাকতো। কেউ টিকে থাকে নাই । মাদক বিক্রেতা ও মাদক সেবিরা সমাজে জঘন্য অপরাধী তার মানে এই নয় যে তাদেরকে খুন করতে হবে। আমরা দাবী জানাচ্ছি আপনারা তাদেরকে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড না করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে যে দেশ আগানোর কথা সেদিকে বাংলাদেশকে পরিচালনা করুন। আমরা দাবী জানাচ্ছি এসব গুম, খুন না করে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনুন।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারন সম্পাদক শরীফউদ্দিন সবুজ বলেন, আমরা সবাই জানি চট্টগ্রামে একজন কাউন্সিলর ক্রসফায়ার হয়েছেন। সারা দেশে আরো প্রায় দেড়শ’র মতো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে গত ১৯ দিনে। এর আগেও দেশে ক্রসফায়ার হয়েছে। কিন্ত অন্যগুলির মতো এটার একটা পার্থক্য রয়েছে। এই ক্রসফায়ারে আগে যিনি শিকার হয়েছেন কথিত ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন একরামুল তিনি তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ হচ্ছিল মোবাইল ফোনে এবং শেষবার মোবাইল ফোনে তিনি যখন তার মেয়েকে সান্তনা দিচ্ছিলেন যে মা তুমি ঘুমাও মা আমি চলে আসবো এরপরেই গুলি হয় সে আর্তনাদ করে ওঠে মৃত্যুর যন্ত্রনা তার মেয়ে তার স্ত্রী শুনতে পায় মোবাইল ফোনে এবং তারা চিৎকার করে উঠে তার স্ত্রী বারবার বলতে থাকে আমার স্বামী কোন অপরাধ করেনি আমার স্বামীকে মারবেন না । এরপর পুরো ক্রসফায়ারের ঘটনাটা মোবাইল ফোনে শোনা যায়। প্রথমে তাকে হত্যা করা হয়, এরপর র্যাবের গাড়ির সাইরেন বেজে উঠলো, বাঁশি ফু দেওয়ার শব্দ শোনা গেল, এরপর দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা গেল, এরপরে যিনি ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন একরামুল, তার মোটরবাইকটি কোনদিকে রাখা হবে, সাজানো যে তিনি মোটরবাইক দিয়ে এসেছিল, এরকম একটি সাজানো ঘটনা সাজানোর জন্য। তার পকেটে পিস্তল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। পড়ে আবার আরেকজন বলছে পিস্তল কি পকেটে রাখে নাকি বাইরে রাখবে। ইয়াবা ঢুকিয়ে রাখা হলো। এই পুরো সবকিছুই নাটক সাজানো হলো যে নাটকটা আমরা প্রেস রিলিজে দেখি। সেই নাটকটি পুরো ঘটনাটা শোনা গেল মোবাইল ফোনে। যেটি আগের কোন ঘটনায় শোনা যায় নি। অর্থাৎ ক্রসফায়ার যে একটি সাজানো নাটক এই ঘটনায় পুরো স্পষ্ট। মোবাইল ফোনটি তারা রেখে দিয়েছে নিজেদের স্বপক্ষে সাফাই গাইতে এটি ধারনা করা হয়। আসলে যা ঘটার যা ঘটে যা সত্য তা চেপে রাখা যায় না এবং ঐ মোবাইল ফোনের সমস্তকিছুই প্রকাশিত হয়ে গেছে। এইযে হত্যাকান্ড একটি মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে অন্যায়ভাবে আবার সেটি মোবাইল ফোনে শুনিয়ে তার পরিবারকে শুনাবে কত বড় নির্মম হলে, কত বড় পিচাশ হলে, এই ঘটনা ঘটাতে পারে। কোন স্বাভাবিক মানুষ এই ঘটনা ঘটাতে পারে না। অনেকে বলে যারা অপরাধী যারা কোর্ট থেকে বেরিয়ে যায় এই কারনেই ক্রসফায়ার। এই কোর্টকে ব্যর্থ করলো কারা। কোর্টকে ব্যর্থ করলো আওয়ামীলীগ, বিএনপির মতো যারা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন। তারা কোর্টকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। কোর্টের স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থা চলতে দেননি। দিনে দিনে কোর্টকে কলুষিত করছেন এবং সেই সরকারি প্রভাবের কারনে বিশেষ করে লোয়ার কোর্ট যেটি তাদের যে স্বাভাবিক কর্মকান্ড সেটি না করে এটি ব্যর্থ বিচার হয়ে দাড়িয়েছে। আইন সবার জন্য সমান সেটা আমাদের কোর্টে গেলে বুঝা যায় যে আইন সবার জন্য সমান না। প্রভাবশালী এবং অর্থশালী বিত্তশালী লোকদের জন্য আইন আর যারা গরীব মানুষ, দূর্বল মানুষ যাদের প্রভাব নেই যাদের অর্থ নেই তাদের জন্য আইন না। তাদের জন্য ধারা না, তাদের জন্য কোর্ট না। এইযে কোর্টকে ব্যর্থ করে দেওয়া এবং এরপরে শুরু হয়েছে ক্রসফায়ারে মানুষকে মেরে ফেলা। সাত খুনের ঘটনায় আমরা দেখেছি যে কিভাবে চুক্তি করে মানুষ মারা যায়। কিভাবে টাকার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে যেভাবে রিকশাওয়ালারা ক্ষেপ মারে সেভাবে তারা রাতের পর রাত ক্ষেপ মেরেছেন মানুষ হত্যা করে। যেখানে আইনের প্রয়োগ থাকবে না সেটা রাষ্ট্র না সেটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। বাংলাদেশকে যদি রাষ্ট্র বলতে চাই তাহলে এই আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। ক্রসফায়ার বন্ধ করতে হবে সমস্ত অপরাধ আইনের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। আরেকটি কথা আমরা অভজারভার পত্রিকায় দেখলাম বদিসহ নারায়নগঞ্জে একজন এমপিসহ দেশের সবোর্চ্চ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে কয়েকজনের নাম ছবিসহ দেখতে পেলাম। কিন্তু সেই টপ লেভেলের কাউকে আমরা আজকে পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। টপ লেভেলের যারা ব্যবসায়ী আছে তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে মাদক ব্যবসা কখনো নির্মূল করা সম্ভব না। আমি দাবী জানাই, নারায়নগঞ্জে গডফাদারসহ সমস্ত গডফাদারদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিন তাহলেই এই মাদক বিরোধী অভিযান ফলপ্রসু হবে।
নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় বলেন, গেল, গেল, সব গেল, আইন গেল, কই। মাদককে কোনভাবে খুন করে খুনী বানানো যাবে, মাদক ব্যবসাকে বন্ধ করতে পারা যাবে না। বিএনপি সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারে নাই, আজও আছে। খুন করে ক্রসফায়ার করে বন্ধ করতে পারে নাই মাদক । বিএনপিও পারে নাই, আপনারাও পারবেন না। ঐ ক্রসফায়ার করে। যদি সত্যিকার অর্থে মাদককে দূর করতে চান তাহলে অবশ্যই স্বাভাবিক ভাবে মানুষকে উদ্ভুদ্ব করেন এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব খুন করা না।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম জীবন বলেন, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। একলক্ষ মাদক ব্যবসায়ী আছে। যারা খুচরা বিক্রেতা তাদেরকে মেরে ফেলে বদিকে বাঁচিয়ে রেখে কোন লাভ নাই। একজন বদিকে ধরা হলে অনেক সুফল আমরা পেতাম। সেটা হয় নাই উলটো তাকে স-সন্মানে পবিত্র ওমরা হজে¦ পাঠানো হইছে।
দেশে বিচার ব্যবস্থায় জনগনের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে অঞ্জন দাস বলেন প্রধানমন্ত্রী আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, দেশের মানুষ মারার দায়িত্ব নেননি। তাই এসব নাটক বন্ধ করুন।
মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক শরীফউদ্দিন সবুজ, সাংস্কৃতিক জোটের সাধারন সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল, সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়, শহুরে গায়েন এর সংগঠক শাহীন মাহমুদ, কবি আহমেদ বাবলু, ছাত্র ফেডারেশন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান খান রিচার্ড, গনসংহতি আন্দোলন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আহ্বায়ক জাহিদুল আলম আল-জাহিদসহ প্রমুখ।